Friday, May 17সময়ের নির্ভীক কন্ঠ
Shadow

মৃত সুমনের জন্য নাশতা নিলো পুলিশ!

নিজস্ব প্রতিবেদক: চুরির মামলায় গ্রেপ্তারের পরদিন সুমন শেখকে আদালতে সোপর্দ করার কথা। যে কারণে ঘটনার দিন সকালে আদালতে তোলার আগেই সুমনের পরিবার থানা হাজতে তার জন্য নাশতা ও কোমল পানীয় নিয়ে যায়। কিন্তু দেখা করতে নিষেধ থাকায় বকশিশের মাধ্যমে এক পুলিশ সদস্যকে দিয়ে নাশতা পাঠিয়ে আদালতে চলে যায় পরিবার। অথচ আদালতে বেশ কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষার পর পরিবার জানতে পারে- সুমনকে নয়, হাতিরঝিল থানা থেকে আদালতে পাঠানো হয়েছে একটি প্রতিবেদন।

যাতে লেখা রয়েছে, সুমন আত্মহত্যা করেছেন। পরিবারের প্রশ্ন, সকালে থানায় গেলেও কেন তাদের জানানো হয়নি সুমনের মৃত্যুর খবর। রাত সাড়ে ৩টার দিকে মারা যাওয়ার ঘটনা সকালেও কেন আড়াল করতে চেয়েছিল পুলিশ? পুলিশের ওই সদস্য কেন মৃত্যুর তথ্য না দিয়ে উল্টো মৃত সুমনকে নাশতা পৌঁছে দেয়ার কথা বলে বকশিশ নিলো?

তবে পুলিশ বলছে, শুক্রবার দিনগত রাত ৩টা ৩২ মিনিটে সুমন তার পরনের ট্রাউজার দিয়ে লোহার গ্রিলের সঙ্গে গলায় ফাঁস দেন, যা সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে। ওই ফুটেজ নিহতের স্ত্রীসহ স্বজনদেরও দেখানোর কথা পুলিশ বললেও নিহতের স্বজনদের দাবি, সুমন রাত সাড়ে ৩টার দিকে মারা গেলো, তাহলে শনিবার সকাল সাড়ে ১০টার সময় পুলিশ কেন নাস্তা নিলো? আবার বলল দুপুরে আদালতে পাঠানো হবে?

এছাড়া সুমনের আত্মহত্যা ও ঝুলে থাকার দৃশ্য সিসিটিভি ফুটেজে দেখেননি বলেও দাবি পরিবারের। থানায় নাটক সাজানোর অভিযোগ করে সুমনের পরিবার বলছে, সিসিটিভির ফুটেজে ট্রাউজার খোলার দৃশ্য তারা দেখেছেন। এরপর সে দেয়াল ধরে উপরে ওঠে। আবার নিজেই নিচে নেমে আসে। যদি ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যাই করে তাহলে ঝুলে থাকার কথা। সিসিটিভি ফুটেজে ঝুলে থাকার দৃশ্য থাকার কথা। কিন্তু ফুটেজে তার ঝুলে থাকার কোনো দৃশ্য দেখা যায়নি। এমনকি ঝুলে থাকলে কোন পুলিশ তাকে নিচে নামালো সেই দৃশ্যও দেখাতে পারেনি পুলিশ।

এরপর সিসিটিভি ফুটেজের ভিডিও বন্ধ করে দিয়ে পুলিশ আমাদের বাইরে যেতে বলে। সিসিটিভিতে আত্মহত্যার প্রমাণ দেখাতে পারেনি পুলিশ।

এদিকে সুমনের লাশ হস্তান্তরে গতকাল পুলিশি শর্তের অভিযোগও করেছে পরিবার। গতকাল দুপুরে থানাহাজত থেকে সুমনের মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের মর্গে পাঠানো হয়। লাশ বুঝে পেতে পরিবার সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের মর্গে গেলেও তারা পুলিশি শর্তের কারণে লাশ বুঝে পায়নি বলে জানায়।

সুমনের স্ত্রী জান্নাত আক্তার বলেন, ‘আমরা লাশ বুঝে পেতে মর্গে গিয়েছিলাম। কিন্তু লাশ আমাদের বুঝিয়ে দেয়া হয়নি। হাতিরঝিল থানা-পুলিশের এক এসআই আমাদের বলেছেন, গ্রামের বাড়ি নবাবগঞ্জে নেয়া হলে লাশ দেয়া হবে। আর যদি বর্তমান বসবাসস্থান ঢাকার রামপুরায় নেয়া হয়, তাহলে লাশ দেয়া হবে না।’

জান্নাত আক্তার বলেন, ‘আমার স্বামী এভাবে মারা গেল। এখন তার লাশও বুঝে পাচ্ছি না।’ জান্নাত আরও বলেন, ‘আমার স্বামীকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আমি এর বিচার চাই। এ ঘটনায় জড়িত পুলিশ সদস্যদের শাস্তি চাই’।

হাতিরঝিল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মেজবাহ উদ্দিন বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে কথা বলতে পারব না। তবে বৈধ দাবিদাররা গেলে লাশ তো বুঝে পাওয়ার কথা।’

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলেন, এ রকম তো হওয়ার কথা না। ব্যাপারটা তারা দেখবেন বলেও আশ্বস্ত করেন।

এদিকে জান্নাত আক্তার জানান, তারা এ ঘটনায় জড়িত পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করবেন। সে জন্য ইতোমধ্যে তারা ঢাকার আদালতে গেছেন। পরে লাশ হস্তান্তরে শর্তের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার আজিমুল হক।

তিনি বলেন, একজন অতিরিক্ত উপকমিশনার মরদেহ নিয়ে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেলের মর্গে অপেক্ষা করছেন। কিন্তু পরিবারের কেউ মরদেহ নিতে আসেননি। এর আগে শনিবার রাতে আজিমুল হক বলেন, ১৫ আগস্ট ইউনিলিভারের পিওরইটের এক বিপণনকারীর ৫৩ লাখ টাকা চুরি হয়। ওই ঘটনায় মামলা হলে আল আমিন, সোহেল রানা ও অনিক নামে তিনজনকে গ্রেপ্তার করে হাতিরঝিল থানা পুলিশ।

তারা এখন কারাগারে আছেন। ওই তিনজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং সিসিটিভির ভিডিও বিশ্লেষণ করে সুমন শেখকে শনাক্ত করা হয়। পরে শুক্রবার বিকালে রামপুরা মহানগর এলাকার বাসা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। সুমন ওই বিপণন কোম্পানির ভ্যানচালক ছিলেন। তিনি আরও বলেন, ‘তার (সুমন) বাসা থেকে তিন লাখ ১৩ হাজার ৭০০ টাকা উদ্ধার করা হয়। পরে তাকে নিয়ে অভিযান চালানো হয়। অভিযান শেষে রাত ১১টার দিকে তাকে থানা হেফাজতে রাখা হয়।’

শনিবার সকালে সুমন শেখকে আদালতে পাঠানোর কথা ছিল জানিয়ে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘কিন্তু রাত ৩টা ৩২ মিনিটে সুমন তার পরনে থাকা ট্রাউজার দিয়ে লোহার গ্রিলের সঙ্গে গলায় ফাঁস দেয়। সিসিটিভি ফুটেজে সেটা দেখা গেছে। ওই ফুটেজ নিহতের স্ত্রীসহ স্বজনদেরও দেখানো হয়েছে।’

তবে সুমনের স্ত্রী এবং পরিবারের সদস্যরা ওই ভিডিওকে ‘অসম্পূর্ণ’ আখ্যায়িত করে ঘটনার তদন্ত দাবি করেছেন। পরিবারের ভাষ্য, সুমন রামপুরায় ইউনিলিভারের পানিবিশুদ্ধকরণ যন্ত্র পিওরইটয়ের বিপণন অফিসে ছয় বছর ধরে কাজ করতেন। মাসে ১২ হাজার টাকা বেতন পেতেন। গত শুক্রবার রাতে সেখান থেকে পুলিশ তাকে মারতে মারতে থানায় নিয়ে যায়।

পুলিশের দাবি, সুমন আত্মহত্যা করেছেন। তবে পরিবারের অভিযোগ, সুমনকে ধরার পর পুলিশ পাঁচ লাখ টাকা দাবি করে। টাকা না দেয়ায় পুলিশ তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। সুমন শেখ পশ্চিম রামপুরার ঝিলকানন এলাকায় পরিবার নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকতেন। তার গ্রামের বাড়ি ঢাকার নবাবগঞ্জের দাড়িকান্দি এলাকায়। সুমনের বাবার নাম পেয়ার আলী। সুমনের মৃত্যুর ঘটনায় বিক্ষুব্ধ স্বজন ও এলাকাবাসী গত শনিবার হাতিরঝিল থানার সামনে বিক্ষোভ করেন।

সুমনের শ্যালক সুজন শেখ বলেন, আমরা আজ মামলা করতে আদালতে গিয়েছিলাম। তবে, আদালতের সময় শেষ হওয়ায় মামলা করতে পারেননি। আজ আমার বোন (সুমনের স্ত্রী) জান্নাত বেগম বাদী হয়ে মামলা করবেন। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা ন্যায় বিচার চাই। সুমন শেখকে হত্যা করেছে পুলিশ। মামলা না করা পর্যন্ত আমরা মরদেহ নেব না।’

সুমনের দুলাভাই মোশাররফ শেখ বলেন, ‘গতকাল আমরা যখন থানার সামনে তখন এক এসআই আমার কাছে জানতে চান, সুমনের মরদেহ আমরা কোথায় নেব। তাকে বলি, রামপুরার বাসায় নেয়া হবে। সেখানে মরদেহ গোসল করিয়ে গ্রামের বাড়িতে নেয়া হবে। তখন তিনি বলেন, না। মরদেহ এখানে আনতে দেয়া হবে না।’

শেয়ার বাটন