Sunday, April 28সময়ের নির্ভীক কন্ঠ
Shadow

দারিদ্র্য বিমোচনে জাকাতের ভূমিকা: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

ধর্ম ডেস্ক: শনিবার (১৯ মার্চ) ইক্যুয়িটি আয়োজিত ‘দারিদ্র্য বিমোচনে যাকাতের ভূমিকা: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ’ শীর্ষক ওয়েবিনারে কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের অর্থনীতি বিভাগের প্রাক্তন উপাধ্যক্ষ প্রফেসর তোহুর আহমদ হিলালী উপস্থাপিত প্রবন্ধ নিচে তুলে ধরা হলো।

বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম
জাকাত কী?
ইসলামে নামাজের পরই জাকাতের স্থান, পাঁচ স্তম্ভের অন্যতম। ইসলাম ও কুফরের মধ্যে পার্থক্যকারী বিষয় যেমন নামাজ তেমনি জাকাতের অবস্থানও তাই। আল্লাহপাক একই সঙ্গে নামাজ ও জাকাতকে ফরজ করেছেন। তাঁর বাণী, ‘আর তোমরা সালাত প্রতিষ্ঠা করো, জাকাত আদায় করো এবং যারা আমার সামনে অবনত হয় তাদের সাথে তোমরাও আমার আনুগত্য স্বীকার করো’- আল বাকারা: ৪৩। কালেমা তাইয়্যেবা ঘোষণার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি ঈমান আনে। ঈমান আনার পর ইসলামের সীমার মধ্যে প্রবেশের জন্য তাকে নামাজ আদায়ের সাথে সাথে জাকাত প্রদানেরও ঘোষণা প্রদান করতে হয়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহপাক বলেন, ‘যদি তারা তওবা করে, সালাত প্রতিষ্ঠা করে ও জাকাত আদায় করে, তাহলে তারা হবে তোমাদের দ্বীনি ভাই’- তওবা: ১১। জাকাত আদায় না করাকে কাফিরদের কাজ বলে আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, ‘তারা জাকাত দেয় না এবং পরকালের ওপরও ঈমান আনে না’- হামীম আস্ সাজদা ৭। একজন ব্যক্তির মুসলমান দাবি করার জন্য নামাজ যেমন অপরিহার্য শর্ত, তেমনি একজন সচ্ছল (নেসাব পরিমাণ সম্পদের অধিকারী) ব্যক্তির জন্য নামাজের সাথে সাথে জাকাতও অপরিহার্য। ইসলামী পরিভাষায় নেসাব পরিমাণ সম্পদের অধিকারীকে বছরে ২.৫% নির্দ্দিষ্ট খাতে প্রদান করাকে জাকাত বলে।

জাকাতের অর্থ :
আভিধানিকভাবে জাকাতের দুটি অর্থ। প্রথমত-বৃদ্ধি, প্রবৃদ্ধি, ক্রমবৃদ্ধি, প্রাচুর্য ইত্যাদি। আল্লাহপাকের বাণী, ‘যা কিছু তোমরা সুদের ওপর দাও, (তা তো এ জন্যেই দাও) যেন তা অন্য মানুষের মালের সাথে (অন্তর্ভুক্ত হয়ে) বৃদ্ধি পায়, আল্লাহ তায়ালার দৃষ্টিতে তা বাড়ে না। অপরদিকে যে জাকাত তোমরা দিয়ে থাক, তা (যেহেতু একান্তভাবে) আল্লাহ তায়ালাকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে দান করো, তাই বৃদ্ধি পায়। এরাই হচ্ছে (সেসব লোক) যারা (জাকাতের মাধ্যমে) আল্লাহর দরবারে নিজেদের সম্পদ বহুগুণে বাড়িয়ে নেয়’- আর রূম: ৩৯।
দ্বিতীয়ত-পবিত্রতা, পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদি। আল্লাহপাকের বাণী, ‘তুমি তাদের ধন-সম্পদ থেকে জাকাত ও সদকা গ্রহণ করো, সদকা দ্বারা তাদের পবিত্র করে দিবে, তুমি তাদের জন্য দোয়া করবে; কেননা, তোমার দোয়া তাদের জন্য (হবে পরম) সান্ত্বনা; আল্লাহ তায়ালা সবকিছু শোনেন এবং সবকিছু জানেন’- তওবা : ১০৩।

জাকাতের গুরুত্ব :
আল্লাহপাক কোনো একটি বিষয় একবার বললেই মানুষ তার গুরুত্ব উপলব্ধি করে পালন করে থাকে। যেমন রোজা মাত্র একবার বলাতেই মানুষ দীর্ঘ একমাস রোজা আদায় করে। কিন্তু জাকাত বিভিন্ন ভঙ্গিতে মোট ৮২ বার উল্লেখ করা হয়েছে। কোথাও জাকাত (৩০ বার), কোথাও সাদাকা (০৯ বার) আবার কোথাও ইনফাক (৪৩ বার) শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে এবং জাকাত আদায় না করার পরিণতি হিসেবে জাহান্নামের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এতে সহজেই আমরা এর গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারি। তারপরও বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে জাকাতের গুরুত্ব এবং দারিদ্র্য বিমোচনে এর ভূমিকা বর্তমান প্রবন্ধে আলোচনা করা হয়েছে।

জাকাত সম্পদ বৃদ্ধি করে :
ব্যক্তিগত পর্যায়ে আল্লাহর পথে ব্যয় প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘যারা নিজেদের সম্পদ আল্লাহর পথে ব্যয় করে তাদের উপমা একটি শস্যবীজ যা সাতটি শীষ উৎপাদন করে, প্রত্যেক শীষে একশত শস্যদানা আর আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বহুগুণে বৃদ্ধি করে দেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময় ও মহাজ্ঞানী’- বাকারা ২৬১। তিনি আরো বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা সুদ নিশ্চিহ্ন করেন, (অপরদিকে) দান-সদকা (উত্তরোত্তর) বৃদ্ধি করেন; আল্লাহ তায়ালা অকৃতজ্ঞ পাপিষ্ঠ ব্যক্তিদের কখনো পছন্দ করেন না’- বাকারা: ২৭৬। জাকাত ও দান-সদাকা শুধু আখিরাতেই নয় আল্লাহপাক এর মাধ্যমে দুনিয়াতেও সমৃদ্ধি দান করেন। বর্তমানে আমাদের দেশে পুঁজিবাদী অর্থনীতি প্রচলিত এবং এই অর্থনীতি সুদনির্ভর। এখানে দান-সদকা একান্তভাবে মানুষের মর্জির উপর নির্ভর করে এবং মানুষ হয়ে পড়ে সংকীর্ণমনা। সম্পদ আহরণের এক অসুস্থ প্রতিযোগিতায় সবাই লিপ্ত। ফলে সম্পদ মুষ্টিমেয় লোকের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ে। পুঁজিনির্ভর অর্থনীতির কারণে ব্যাপক উৎপাদন হয়। কিন্তু ক্রয়ক্ষমতার অভাবে ব্যাপক চাহিদা সৃষ্টি হয় না। অর্থাৎ সমাজে মোট আয়ের তুলনায় ব্যয় হ্রাস পায়। যেটাকে আমরা মন্দা বলে থাকি। পুঁজিবাদী অর্থনীতির কারণে মাঝে-মধ্যেই আমরা মন্দার সম্মুখীন হই। মন্দার ফলে অর্থনীতি বিপরীত দিকে চলা শুরু করে। অর্থাৎ স্বল্প চাহিদা > স্বল্প বিনিয়োগ > স্বল্প কর্মসংস্থান > স্বল্প উৎপাদন > স্বল্প আয় চক্রাকারে চলতে থাকে। যেটা বিশ্ববাসী প্রথম প্রত্যক্ষ করেছিল ১৯৩০-এর দশকে এবং এ মন্দা এখনও বিশ্ব অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে তুলছে। সে সময়ের সাড়াজাগানো অর্থনীতিবিদ লর্ড কেইনস পুঁজিবাদী অর্থনীতির ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভুত হন। ক্লাসিক্যাল অর্থনীতিবিদদের দৃষ্টিভঙ্গি (সামষ্টিক অর্থনীতিতে কোনো সমস্যা নেই এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে সমাজের মোট আয় ও ব্যয় সমান হবে (Supply creates its own demand) থেকে বেরিয়ে এসে তিনি বললেন সমাজের মোট আয় ও ব্যয় স্বয়ংক্রিয়ভাবে সমান হয় না এবং আয়ের তুলনায় ব্যয় কম হয়। তিনি ব্যয় বৃদ্ধির তাগিদ দেন এবং এ ব্যাপারে সরকারি হস্তক্ষেপের কথাও জানান। ধনীদের তুলনায় দরিদ্রদের ভোগপ্রবণতা অনেক বেশি। কারণ তাদের মৌলিক প্রয়োজনই অপূর্ণ থেকে যায়। তাই তাদের হাতে অর্থ আসার সাথে সাথে তারা বাজারে ছুটে যায়। যে সমাজের প্রান্তিক ভোগপ্রবণতা যতো বেশি সে সমাজে আয় সৃষ্টিও তত বেশি। অর্থনীতিবিদরা হিসাব করে বলে দিলেন, একটি সমাজের প্রান্তিক ভোগপ্রবণতা ৮০% হলে সে সমাজে ১০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করলে ৫০০ কোটি টাকা আয় সৃষ্টি হবে। আবার ভোগপ্রবণতা ৫০% হলে আয় হবে ২০০ কোটি টাকা।

জাকাত ধনীরা বাধ্যতামূলকভাবে প্রদান করে থাকে আর দরিদ্ররা তাদের অধিকার হিসেবে গ্রহণ করে। জাকাত বন্টনের খাতগুলো লক্ষ করলে দেখা যায় সবই দরিদ্ররা পেয়ে থাকে এবং সমাজের সামগ্রিক চাহিদার উপর এর একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। ফলে জাকাত প্রদানের ফলে জাকাতদাতা আল্লাহপাকের প্রতিশ্রুতি মোতাবেক দুনিয়া ও আখেরাতে তার উত্তম বিনিময় পাবেনই উপরন্তু সামগ্রিকভাবে সমাজে উৎপাদন বাড়বে, কর্মসংস্থান বাড়বে, বিনিয়োগ বাড়বে, আয় বাড়বে। এছাড়াও দরিদ্রদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশের কারণে সমাজে ধনী-দরিদ্রের মধ্যে যে হিংসা-বিদ্বেষ তাও দূর হবে। পক্ষান্তরে সুদের হারের সাথে বিনিয়োগের সম্পর্ক ঋণাত্বক হওয়ায় কর্মসংস্থান হ্রাস পাবে, উৎপাদন হ্রাস পাবে এবং আয়ও হ্রাস পাবে। সুদ কেবল আখেরাতেই ধবংস ডেকে আনে না, দুনিয়াতেও ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়।

জাকাত সম্পদ পবিত্র করে :
ইসলাম হারাম উপার্জনের সকল উৎস বন্ধ করে দিয়েছে। সুদ, ঘুষ, ধোকা-প্রতারণা, খেয়ানত, ওজনে কম দেয়া, ভেজাল দেয়া, জনস্বার্থের পরিপন্থি ও শোষণমূলক সবই হারাম এবং এর কোনো একটি সম্পাদনের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন কবিরা গুনাহ যার পরিণতি জাহান্নাম। পরিত্রাণের উপায় হলো আল্লাহর কাছে তওবা করা এবং যাদের হক নষ্ট করা হয়েছে তাদের হক ফিরিয়ে দেয়া। আজ ধনী-দরিদ্রের মধ্যে যে আকাশচুম্বি বৈষম্য এর মূলে রয়েছে সীমাহীন দুর্নীতি। বৈধভাবে উপার্জনের পরও সম্পদ তখনই পবিত্র হবে যখন তার হিসাব করে জাকাত প্রদান করা হবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘তাদের ধনমাল থেকে জাকাত গ্রহণ করো আর এভাবে তোমরা তাদেরকে (প্রকাশ্যেও) পবিত্র করো এবং (গোপনেও) পরিচ্ছন্ন করো’। জাকাত না আদায় করলে তার সম্পদ হবে অপবিত্র যার পরিণতি জাহান্নাম। তিনি বলেন, ‘আর যারা স্বর্ণ ও রুপা সঞ্চিত করে এবং আল্লাহর পথে তা ব্যয় করে না; তাদের যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ শুনিয়ে দাও। যেদিন ঐসব স্বর্ণ ও রুপাকে জাহান্নামের আগুনে জ্বালিয়ে দগ্ধ করা হবে, তারপর তা দিয়ে তাদের কপালে, পাঁজরে ও পিঠে সেঁকা দেয়া হবে আর বলা হবে : এ হচ্ছে, তোমরা নিজেরা যা সঞ্চয় করেছিলে তা। কাজেই যা সঞ্চয় করেছিলে, তা কেমন মজা লাগে উপভোগ করো’- তওবা ৩৪-৩৫। আমাদের দেশীয় আইনে দেখি বৈধ উপায়ে উপার্জনের পর যদি কর প্রদান না করা হয় তাহলে তা কালো টাকায় পরিণত হয় যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আবার কর বাদে অতিরিক্ত ১০% প্রদান করে তা সাদা করার সুযোগও মাঝে-মধ্যে দেয়া হয়। ইসলাম রাষ্ট্রীয় দ্বীন। কেউ জাকাত দিতে অবহেলা করলে সরকার জাকাত দিতে বাধ্য করবে এবং এরকম ক্ষেত্রে জাকাত আদায়ের পর সরকার তার সম্পদের অর্ধেক নিয়ে নিতে পারবে। আর কেউ যদি জাকাত দিতে অস্বীকার করে তবে সরকার তাকে মুরতাদ ঘোষণা করে মৃত্যুদণ্ড দিতে পারবে।

যে সকল সম্পদে জাকাত ফরজ হয় :
ইসলাম যে সকল সম্পদে জাকাত ফরজ করেছে, তা হলো : স্বর্ণ, রৌপ্য, নগদ অর্থ, কৃষিজাত শস্যাদি, ফলমূল, বাণিজ্যিক পণ্য, চরণশীল পশু, খণিজ সম্পদ ও মাটির নিচে প্রোথিত মূল্যবান সম্পদ। ফসলের জাকাতকে ওশর বলা হয়। ফসলের জাকাত প্রসঙ্গে আল্লাহপাক বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা যে সকল হালাল জিনিস উপার্জন করেছ, তা থেকে এবং আমি তোমাদের জন্য মাটি হতে যা যা উৎপন্ন করেছি তা থেকে ব্যয় করো’- বাকারা ২৬৭। আল্লাহ আরো বলেন, আর তিনিই সেই সত্তা যিনি সৃষ্টি করেছেন বাগানসমূহ, যার কতক মাচান অবলম্বী এবং কতক মাচানবিহীন এবং খেজুর গাছ ও শস্য ক্ষেত, যাতে বিভিন্ন স্বাদের খাদ্যশস্য উৎপন্ন হয়, আর জয়তুন ও ডালিম, যা পরস্পর সদৃশ ও অসদৃশ। যখন ফলবান হয় তখন তা থেকে ফল খাও এবং ফসল কাটার দিন তার হক আদায় করো’- আনয়াম ১৪১।
ফসলের নেসাব প্রসঙ্গে ফকিহদের মাঝে মতপার্থক্য রয়েছে। ইমাম আবু হানিফা রহ. নেসাব স্বীকার না করে বলেন, ফসল কাটার সময় (বৃষ্টির পানিতে সিক্ত) দশ ভাগের একভাগ কিংবা সেচের মাধ্যমে উৎপন্ন ফসলের বিশভাগের একভাগ আল্লাহর হক হিসাবে আদায় করতে হবে। অন্যরা বলেছেন শাকসব্জি ও তরকারিতে জাকাত নেই। ইমাম আবু হানিফা এবং আবু ইউসুফ ও মুহাম্মদের মতে ভূমি থেকে যা কিছুই উৎপন্ন হয় তারই জাকাত দিতে হবে।

জাকাতের নেসাব :
ফকিহদের মাঝে মতপার্থক্য থাকলেও অধিকাংশের মতে ফসলের ক্ষেত্রে নেসাব হলো উৎপন্ন ফসল প্রত্যেকটি আলাদা পাঁচ ওয়াসাক হতে হবে। এই মর্মে হাদিস রয়েছে। পাঁচ ওয়াসাক বলতে কেউ কেউ বলেছেন ৬৫৩ কেজি (১৮ মণ)। ফসলের ক্ষেত্রে বছর পূর্ণ হওয়ার শর্ত নেই। ফসল কাটার দিন আদায় করতে হবে।
স্বর্ণ ও রূপার ক্ষেত্রে নেসাব ৭.৫ তোলা স্বর্ণ ও সাড়ে ৫২.৫ তোলা রূপা কারো মালিকানায় এক বছর থাকলে তাকে ২.৫% জাকাত প্রদান করতে হবে। নগদ টাকা ও ব্যবসায়ী পণ্যের মূল্য একত্র করে জাকাত হিসাব করা হয়। নেসাব নির্ধারণে স্বর্ণ ও রূপার ভিত্তিতে পরিমাপের ক্ষেত্রে ফকিহদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। বর্তমান সময়ে জাকাতের নেসাব স্বর্ণের ভিত্তিতেই হওয়া উচিৎ। সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ ও সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্য মূল্যমানে ব্যাপক পার্থক্য। এ ছাড়া বর্তমানে আমাদের দেশসহ অধিকাংশ দেশে স্বর্ণকেই মূল্যমান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ অথবা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্য বা সমপরিমাণ সম্পদের মালিককে সাহেবে নেসাব বলে। শরীয়তে যেখানে অথবা রয়েছে সেখানে আমার দৃষ্টিতে যে কোনো একটি গ্রহণের সুযোগ রয়েছে।

জাকাত ধনীদের কাছ থেকে গ্রহণ করে দরিদ্রদের মধ্যে বন্টনের জন্য বলা হয়েছে। সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্যমান একজন ধনীর মানদণ্ড হতে পারে না। যেখানে বলা হয়েছে যে, উটের ৫টির কমে জাকাত নেই, গরু-মহিষে ৩০টি এবং ছাগল-ভেড়া ৪০টির কমে জাকাত নেই। এ সব বিবেচনায় আনলে সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণই উপযুক্ত মানদণ্ড হতে পারে। উট, গরু, ছাগল একত্র করে নেসাব নির্ধারিত হয় না, বরং পৃথক পৃথকভাবে সংখ্যা থাকতে হয়। আবার ফসলও পৃথক পৃথক থাকতে হয়। কারো মালিকানায় স্বর্ণ ও রৌপ্য আলাদাভাবে নেসাব পরিমাণ থাকলে তাকে জাকাত দিতে হবে। 
মহিলাদের ব্যবহৃত গহনার ব্যাপারে বেশ ভিন্নমত রয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে জাকাত না ধরার ক্ষেত্রে মতটিই প্রবল ও যুক্তিযুক্ত। জাকাতের ক্ষেত্রে বর্ধনশীলতা একটি শর্ত। অর্থাৎ যে মালে প্রবৃদ্ধি আছে তা নেসাব পরিমাণ হলে তার জাকাত দিতে হবে। মহিলাদের অলঙ্কার যদি ব্যবহারের উদ্দেশ্যে কেবল হয়ে থাকে এবং তা নির্দিষ্ট পরিমাণের মধ্যে হয় তাহলে তার জাকাত হবে না। কারণ তাতে কোনো প্রবৃদ্ধি নেই এবং জাকাত প্রদানের মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে তা নিঃশেষ হয়ে যাবে। কিন্তু সম্পদ হিসেবে অলঙ্কাররূপে স্বর্ণ-রৌপ্য মজুদ রাখে তখন তা নগদ টাকার মতই বিবেচিত হবে এবং তার জাকাত দিতে হবে।

উদাহরণস্বরূপ একজন মহিলার কাছে ২/৩ ভরি স্বর্ণ বা ৩/৪ ভরি রৌপ্য আছে (বিয়ের সময় পিতা ও শ্বশুর বাড়ির পক্ষ থেকে উপঢৌকন হিসেবে প্রাপ্ত) এবং তার বাড়িতে নিজের পরিচালনায় লবণ-তেলের একটি ছোট্ট দোকান বা কিছু নগদ টাকা আছে এবং সব একত্র করে রৌপ্যের হিসেবে জাকাতের নেসাব ধার্য করার রেওয়াজ আমাদের সমাজে চালু রয়েছে। আসলে ঐ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী একজন দরিদ্র মহিলা। সে তার আয় দিয়ে সম্মানজনক জীবন পরিচালনা করতে পারে না। রসুল সা.-এর স্পষ্ট উক্তি- ধনাঢ্যতার প্রকাশ থেকে জাকাত হবে- এই শর্ত এখানে প্রতিপালিত হয় না। তার ব্যবসার পণ্য ও নগদ টাকা যদি সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণমানের সমপরিমাণ হয় তাহলে তার মধ্যে ধনাঢ্যতার প্রকাশ পেত। এমতাবস্থায় আমার ধারণা তার জাকাত নেই। আমার দৃষ্টিতে ঐ মহিলার স্বর্ণ-রৌপ্য একান্তই ব্যবহার্য এবং তার গহনারও কোনো জাকাত নেই। জাকাতের ক্ষেত্রে মূলধন দ্রব্য এবং ব্যবহার্য দ্রব্যের জাকাত হয় না। একজন মহিলাকে স্বর্ণ এবং রৌপ্য ব্যবহারের জন্য একটি নির্দিষ্ট সীমারেখা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। সম্পদ বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে যারা স্বর্ণ-রৌপ্য জমা করে ও জাকাত দেয় না মূলত হুশিয়ারী তাদের উদ্দেশ্যেই।

জাকাত দারিদ্র্য বিমোচন করে :
আল্লাহপাক সমগ্র সৃষ্টির স্রষ্টা হওয়ার সাথে সাথে এর লালন-পালনের দায়িত্বও তাঁর এবং এ কাজটি তিনি তাঁর প্রতিনিধির মাধ্যমে সম্পাদন করতে চান। তিনি তাঁর সমগ্র সৃষ্টির প্রতি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল। সাথে সাথে তিনি এটাও চান যে তাঁর প্রতিনিধিরা তাঁর মতই উদার ও প্রশস্ত হৃদয়ের অধিকারী হবে। আল্লাহপাকের বাণী, ‘যে স্বীয় মনের সংকীর্ণতা হতে নিজেকে রক্ষা করলো সেই প্রকৃত কল্যাণ লাভ করলো’-আত্ তাগাবুন: ১৬। সকল মানুষকে তিনি সম মেধা, যোগ্যতা, সুযোগ দান করেননি। প্রত্যেককে তার মেধা, যোগ্যতা ও প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধার ভিত্তিতে জবাবদিহি করতে হবে। দুনিয়া একটি পরীক্ষাগার। কাউকে তিনি দিয়ে পরীক্ষা নিচ্ছেন আবার কাউকে না দিয়ে পরীক্ষা নিচ্ছেন। তাই স্বাভাবিকভাবে যাকে সম্পদ বেশি দেয়া হয়েছে তার উপর দায়িত্বও বেশি অর্পিত হয়েছে। আল্লাহর বাণী, ‘তাদের সম্পদে প্রার্থী ও বঞ্চিত জনের প্রাপ্য রয়েছে’- আযযারিয়াত ১৯। জাকাতদাতা সন্তষ্টচিত্তে তার সম্পদ থেকে তার গরীব ভাইয়ের প্রাপ্য বের করে দিয়ে তার সম্পদকে পবিত্র করবে এবং সমাজ থেকে দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়তা করবে। জাকাত মূলত রাষ্ট্রীয়ভাবেই আদায়যোগ্য বিধান এবং সরকারের অন্যতম মৌলিক কাজ। আল্লাহপাকের বাণী, ‘তারা এমন লোক, যাদেরকে আমি পৃথিবীতে রাষ্ট্রক্ষমতা দিলে তারা নামাজ কায়েম করে, জাকাত ব্যবস্থা চালু করে, সৎ কাজের আদেশ দেয় ও অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করে। বস্তুত: সব কাজের শেষ ফায়সালা আল্লাহর হাতে ন্যস্ত’- আল হাজ ৪১। রসুল সা. এবং সাহেবায়ে কেরাম রা. সরকার প্রধান হিসেবেই জাকাত আদায় করেছেন। তাঁরা ধনীদের নিকট থেকে গ্রহণ করে দরিদ্রদের মধ্যে তা বন্টন করেছেন। জাকাতের আটটি খাতের মধ্যে দরিদ্রদের অংশটাই প্রাধান্য পেয়েছে। খাতসমূহ: ‘জাকাত তাদের প্রাপ্য যারা দরিদ্র, মিসকিন, যারা জাকাত আদায়ের কর্মচারি, যাদের চিত্ত আকর্ষণ কাঙ্ক্ষিত এবং দাস মুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে এবং মুসাফিরদের জন্য। এটা আল্লাহর নির্ধারিত বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ প্রজ্ঞাবান’- তওবা ৬০। জাকাতের উদ্দেশ্য হলো, দরিদ্রকে দারিদ্র্য মুক্ত করা ও তার প্রয়োজন মেটানো। তাই জাকাত যে পরিমাণ দিলে সে দারিদ্র্য থেকে স্থায়ীভাবে সচ্ছল হতে পারবে এবং পরমুখাপেক্ষিতা থেকে মুক্ত হয়ে স্বনির্ভর হতে পারবে, সেই পরিমাণ তাকে দিতে হবে। এভাবে দারিদ্র্য বিমোচন সরকারি ব্যবস্থাপনায় কেবল সম্ভব। কিন্তু আমাদের দেশে সরকারি উদ্যোগে নামাজের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় বাধ্যতামূলক জাকাত আদায় সরকার নৈতিকভাবে সক্ষম হচ্ছে না। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে যে জাকাত আদায় হয় তা একান্তই ঐচ্ছিক এবং পরিমাণেও সামান্য।

আল্লাহর পথে :
জাকাত বন্টনের সুনির্দ্দিষ্ট খাতসমূহ উল্লেখের পর ফি সাবিলিল্লাহ খাত ব্যাপক অর্থপূর্ণ। কারণ বাকি ০৭টি খাতে ব্যয়ও মূলত আল্লাহর পথেই। আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে যে কোনো নেক কাজে ব্যয়ই আল্লাহর পথে। যুগের প্রয়োজনে সমসাময়িক ফকিহরা অগ্রাধিকার নির্ধারণ করে এ খাতে ব্যয় ঠিক করতে পারেন। একটা সুযোগ শরীয়ত প্রণেতা উন্মুক্ত রেখেছেন। ফি সাবিলিল্লাহ জিহাদ ফি সাবিল্লিাহ অবশ্যই। কিন্তু নির্দ্দিষ্ট করে দেয়া হয়নি। বর্তমান যুগে উম্মাহ বহুমুখি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠায় নানামুখি তৎপরতা বিশেষ করে বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতা বেশি প্রয়োজন। জ্ঞানের দৈন্যতা উম্মাহর জন্য বড় সমস্যা। পত্র-পত্রিকা, বই-পুস্তক রচনা এবং দ্বীনের প্রচার ও প্রসারে মুবাল্লিগ নিয়োগ কাজে এ খাত থেকে ব্যয় করা যেতে পারে। যে সব সংগঠন এসব কাজ আঞ্জাম দেয় তাদের জাকাত থেকে প্রদান করা উত্তম হিসেবে বিবেচিত হবে। এ ছাড়াও দরিদ্রদের মাঝে দ্বীনি শিক্ষা প্রসারে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা এবং ছাত্র- শিক্ষকের প্রয়োজন পূরণও হতে পারে।

শিক্ষকদেরকে সম্মানি দেয়া যাবে যদি তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত থাকার কারণে আয় উপার্জনের আর কোনো সুযোগ না পান। আল্লাহর বাণী, ‘এটা (জাকাত) প্রাপ্য সেসব অভাবগ্রস্ত লোকদের, যারা আল্লাহর কাজে নিয়োজিত থাকায় জীবিকার জন্য জমিনে পদচারণা করতে পারে না এবং (আত্মসম্ভ্রমের কারণে) কারও নিকট হাত পাতে না বলে অজ্ঞ লোকেরা তাদের অভাবমুক্ত মনে করে। তোমরা তাদের (দারিদ্রের) লক্ষণ দেখে চিনতে পারবে। তারা মানুষের নিকট মিনতি করে যাচনা করে না। আর যে কল্যাণকর কিছু তোমরা ব্যয় করো, নিশ্চয় আল্লাহ তা সবিশেষ অবহিত’- বাকারা ২৭৩। বর্তমানে অনেক মাদ্রাসায় ঘুরিয়ে জাকাত নেয়া হয়। আমার দৃষ্টিতে কোনো প্রয়োজন নেই, যেহেতু শরীয়ত প্রণেতা উদার দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছেন। ফকিহদের দৃষ্টিভঙ্গি হলো, ইবাদত পালনের ক্ষেত্রে জাকাত দেয়া যাবে না কিন্তু জ্ঞানার্জনে দেয়া যাবে। ড. ইউসুফ আল কারজাভী রচিত ইসলামের জাকাত বিধান (ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রকাশিত ও মাওলানা আব্দুর রহীম অনূদিত ২ খন্ডে ৫০৩+৭০৯= ১২১২ পৃষ্ঠার এক অনবদ্য কীর্তি) এবং সাইয়েদ সাবেক (ফিকহুস সুন্নাহ, পৃষ্ঠা ৬০৮) বই পড়ে আমার মাঝে এমন উপলব্ধি আসছে। আমি তাঁদেরকে বর্তমান বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম ফকিহদের অন্যতম মনে করি।

জাকাত সংগ্রহ পদ্ধতি :
জাকাতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য দেশ থেকে দারিদ্র্য বিমোচন। এটা রাষ্ট্রীয়ভাবে আদায় ও বন্টনের মাধ্যমেই কেবল সম্ভব। আল্লাহপাক তাঁর রসুলকে ধনীদের নিকট থেকে আদায় করে তা দরিদ্রদের মধ্যে বন্টনের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। কুরআন মজিদে বিভিন্ন ভঙ্গিতে বলা হয়েছে তাদের নিকট থেকে জাকাত আদায় করো এবং পবিত্র করো ইত্যাদি এবং রসুল সা. ও তাঁর সাহাবিদের আমলও ছিল তাই। কুরআন মজিদে রাষ্ট্র সরকারের ৪টি দায়িত্বের কথা বলা হয়েছে- তার মধ্যে নামাজ কায়েম ও জাকাত আদায় অন্যতম। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থায় সরকার সে দায়িত্ব আঞ্জাম দিতে পারছে না। ফলে জাকাতের মতো এতো কল্যাণকর ব্যবস্থার সুফল থেকে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি। অথচ রসুল সা. ও তাঁর সাহাবিরা রা. খুবই স্বল্প সময়ের মধ্যে হেজাজের মতো একটি দরিদ্র দেশকে সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করেছিলেন। আমাদের দেশে ব্যক্তিগত পর্যায়ে জাকাত প্রদানের মাধ্যমে মূলত দারিদ্র্য বিমোচন নয় বরং দারিদ্রের চাষ হয। এতে জাকাতদাতার মধ্যে থাকে একটা প্রদর্শনীভাব এবং গ্রহীতার মধ্যে থাকে চরম হীনমন্যতা। পবিত্র রমজান মাসে জাকাত সংগ্রহে পদদলিত হওয়া ও পুলিশের লাঠির আঘাতের কথা পত্রিকায় আমাদের চোখে পড়ে। এ থেকে আমাদের পরিত্রাণ দরকার। সরকার আমাদের দেশে নামাজ আদায়ের ব্যবস্থা না করতে পারলেও মানুষ স্বউদ্যোগে মসজিদ নির্মাণ ও ইমাম-মুয়াজ্জিন নিয়োগের মাধ্যমে জামায়াতে নামাজ পড়ার সুন্দর ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। আমাদের এ জনপদে দীর্ঘকাল থেকে নামাজের সুষ্ঠু ব্যবস্থা থাকলেও জাকাতের ব্যাপারে ঔদাসীন্য লক্ষণীয়। হিসাব করে জাকাত আদায় এবং ফসলের জাকাত ওশর আদায়ে খুবই দুর্বলতা রয়েছে। অথচ নামাজ ও জাকাতের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করার কোনো সুযোগ নেই। ইবনে যায়েদ রা. বলেন, ‘নামাজ ও জাকাতকে একসঙ্গে ফরজ করা হয়েছে, এ দুটির মধ্যে কোনরূপ পার্থক্য করা হয়নি’। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন, ‘তোমাদের একসঙ্গে আদেশ করা হয়েছে নামাজ কায়েম করতে ও জাকাত আদায় করতে। তাই কেউ জাকাত আদায় না করলে তার নামাজও হবে না’। খালিদ বিন ওয়ালিদ রা. বলেন, ‘নামাজ ও জাকাত একটি অপরটির সম্পুরক, একটি ছাড়া অন্যটি কবুল হয় না’। নামাজের ব্যাপারে আমরা অনেকখানি আন্তরিক, বিশেষ করে মসজিদ কমিটিকে অনেক ব্যস্ত দেখা যায়। নামাজের মতো জাকাতও সামষ্টিক ইবাদত এবং জাকাত আদায়ে নিয়োজিত কর্মচারিদের বেতন-ভাতা প্রদান জাকাতের অন্যতম খাত। মসজিদ কমিটির তত্ত্বাবধানে মহল্লার সকলে মিলে মসজিদে ইমামের নেতৃত্বে যেমন নামাজ আদায় করেন তেমনি মহল্লাহর সকলের জাকাত একত্র করে মহল্লার দুস্থদের তালিকা প্রণয়ন করে তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সেনিটেশন ও দারিদ্র্য বিমোচনে কার্যকর ভূমিকা রাখা যেতে পারে। এ লক্ষ্যে মসজিদ এলাকায় জাকাত প্রদানের উপযুক্ত লোকদের তালিকা প্রণয়ন, তাদেরকে একত্রিত করে জাকাত দানে উদ্বুদ্ধকরণের কাজ মসজিদ কমিটি থেকে হতে পারে এবং এসব কাজে যে ব্যয় তা জাকাত ফান্ড থেকে বহন করা যায়। এ ছাড়াও জাকাত আদায় ও বন্টনের লক্ষ্যে এলাকাভিত্তিক বা জাতীয়ভিত্তিক সংগঠন গড়ে তোলা যায় যাদের কাজ হবে জাকাত সংগ্রহ করে তার ওপর ভিত্তি করে দরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান গড়ে তোলা। সর্বোপরি আমাদের এমন সরকার ব্যবস্থা কায়েমের জন্য আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালানো উচিত যাদেরকে আল্লাহপাক রাষ্ট্রক্ষমতা দান করলে তাঁর ঘোষণা মোতাবেক তারা নামাজ কায়েম ও জাকাত আদায়ের ব্যবস্থা এবং সমাজ থেকে দুষ্কৃতি দূর করে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। মূলত এ প্রচেষ্টার মধ্যেই রয়েছে দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ। যেসব সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান দ্বীন কায়েমের কাজে নিয়োজিত তাদেরকে জাকাত প্রদান করে তাদের কাজকে এগিয়ে নেয়াকে উত্তম বলে মনে করি।

বাংলাদেশে জাকাত আদায় :
বাংলাদেশ একটি কৃষিভিত্তিক দেশ এবং গ্রামে হতদরিদ্র মানুষের বাস বেশি। কৃষিজাত ফসলের ওশর আদায় করা হলে গ্রামে প্রচুর জাকাত (ওশর) আদায় সম্ভব। আমাদের দেশে কী পরিমাণ জাকাত ও ওশর আদায় সম্ভব তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যাণ নেই। শাহ আব্দুল হান্নান রহ. তাঁর এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, বাংলাদেশে একটি বছরে ওশর থেকে কমপক্ষে ছয় হাজার টাকা আদায় হওয়া সম্ভব। সরকার ওশর আদায় করে খুব সহজেই গ্রামের দারিদ্র্য দূর করতে পারেন। ওশর ও জাকাত আদায় ও বন্টনে বিপুল পরিমাণ মানুষের কর্মসংস্থানও জাকাত ফান্ড থেকে করা যেতে পারে। কিংবা জাতীয় ও অঞ্চলভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে সামষ্টিকভাবে ওশর আদায়ের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। শহর এলাকার সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি চাকরিজীবী সবাই জাকাতের আওতায় আসে।

উপসংহার :
জাকাত একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত, অন্যতম বুনিয়াদ এবং আখিরাতে নাজাতের উপায় হওয়ার সাথে সাথে দুনিয়ার জীবনেও একটি সচ্ছল ও সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে টিকে থাকার উপায় হিসেবে ভূমিকা পালন করে। জাকাত দিলে সম্পদ কমে না বরং ব্যক্তিগত ও সামষ্টিকভাবে সম্পদ অনেক বেড়ে যায় এবং জাকাত আদায় না করার মধ্যে আমাদের ধ্বংস নিহিত রয়েছে। আল্লাহপাকের বাণী, ‘আল্লাহর পথে খরচ করো এবং আপন হাতে নিজেদেরকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যেও না। ইহসানের পথে চলো’- বাকারা ১৯৫। মেধা, যোগ্যতা, সুস্থতা ও সম্পদ সবই আল্লাহর। আল্লাহ বার বার বলছেন ‘আমরা যে রিজিক দিয়েছি তা থেকে খরচ করো’। আল্লাহর দেয়া রিজিক তাঁর বান্দাদের প্রয়োজনে, তাঁর দ্বীনের প্রয়োজনে উদার হস্তে আমরা খরচ করি এবং কতো খরচ করছি তা হিসাব না করি তা হলে আল্লাহও আমাদেরকে উদার হস্তে দান করবেন। আল্লাহপাক আমাদেরকে সকল সংকীর্ণতার ঊর্দ্ধে উঠে হিসাব করে জাকাত আদায়ের মাধ্যমে তাঁর প্রিয়ভাজন বান্দা হওয়ার তৌফিক দান করুন।

শেয়ার বাটন