

সীমন্ত ডেস্ক: যুদ্ধ কতদিন চলবে? এখন তা কারো জানা নেই। এ যুদ্ধে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে বিশ্বের ভবিষ্যৎ। ইউক্রেনে রাশিয়ান আগ্রাসনের ঝাঁজ এখনই টের পেতে শুরু করেছে সারা দুনিয়া। যুদ্ধ ইউরোপে হলেও বহু সংকটে পড়বে বাংলাদেশ। এখনই ব্যারেল প্রতি তেলের দাম ছাড়িয়েছে ১০০ ডলার। প্রভাবের অংশ দেশেরও রয়েছে। রাশিয়ান আগ্রাসনকে দেখা হচ্ছে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হিসেবে।
বাংলাদেশের বিশ্লেষকরা বলছেন, যুদ্ধের দুই পক্ষ থেকেই সমর্থন চেয়ে বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে প্রতিটি মুহূর্ত। যাতে বাংলাদেশ কোনোভাবেই কোনো পক্ষের সাথে না মিলে যায়। কৌশলগত নিরপেক্ষতা যেকোনো মূল্যে বজায় রাখতে হবে।
কোনো সংঘাতের পক্ষই নেয়া যাবে না। কেন না, প্রযুক্তির কারণে আন্তঃসংযুক্ত বিশ্বে ইউক্রেন খুব দূরের জায়গা নয়। আন্তঃরাষ্ট্রীয় যোগাযোগের কারণে সংঘাত হলে তার সরাসরি প্রভাব অন্যান্য দেশেগুলোতেও যেমন পড়বে তেমনি বাংলাদেশও বাইরে থাকবে না। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত রপ্তানির ওপর নির্ভর করে। দীর্ঘস্থায়ী কিছু হতে চললে তার বড় প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের পোশাক খাতেও।
এ ছাড়া বাংলাদেশের সশস্ত্রবাহিনী, বিশেষ করে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর কাছে রাশিয়ার তৈরি সামরিক সরঞ্জাম আছে। বাংলাদেশের মিগগুলো রাশিয়ার তৈরি। বাংলাদেশের হেলিকপ্টারবহরের অনেকগুলোই রাশিয়ার তৈরি।
সামপ্রতিক সময়ে বাংলাদেশ আটটি ‘অ্যাটাক হেলিকপ্টার’ কিনেছে রাশিয়ার কাছ থেকে। এসব স্বার্থের সাথে বাংলাদেশের সমর্থন যৌক্তিকভাবেই চাইতে পারে। না দিলে প্রভাব পড়ার বিষয়টিও উড়িয়ে দেয়া যায় না। জ্বালানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ একটি আমদানিনির্ভর দেশ। এই সংঘাতের কারণে তেলের বাজার সম্পূর্ণভাবে অস্থিতিশীল হয়ে গেছে। দ্রুতই দাম বাড়ছে। এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া ও চাপ বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর পড়বে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রাবাজার পুরোপুরি অস্থির হয়ে গেছে। এর যে অর্থনৈতিক চাপ, তা বাংলাদেশের ওপর পড়া শুরু করবে। বিশ্বের গম রপ্তানির বড় অংশই আসে রাশিয়া, ইউক্রেন ও বেলারুশ অঞ্চল থেকে। ফলে গমের রপ্তানি বাজার পুরোপুরি বিঘ্নিত হয়ে যেতে পারে। এ ছাড়া খুব তীক্ষ্ম দৃষ্টি রাখতে হবে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দিকে। কেন না, পাবনার যে ঈশ্বরদীর রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাস্তবায়িত হচ্ছে তা যদি রাশিয়া ও রাশিয়ার বিভিন্ন সংস্থা পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার আওতায় চলে আসে তাহলে বাংলাদেশের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাস্তবায়ন অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে।
এদিকে প্রতি মুহূর্তেই দৃশ্যপট পরিবর্তন হচ্ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের দ্বিতীয় দিনই পুতিন-সেনার হামলায় মাথার ছাদ হারিয়েছেন বহু সাধারণ মানুষ। কিভ থেকে চুহুইভ, খারকিভ থেকে মারিয়ুপুল। গোটা ইউক্রেনজুড়ে ধ্বংসলীলার হাহাকার। আকাশপথে হামলার সময় ইউক্রেনের সেনাঘাঁটির পাশাপাশি উড়েছে সাধারণ মানুষের ঘরবাড়িও। শুধু বিশেষ একটি দেশে যুদ্ধই নয়, ইউক্রেনে জিততে মরিয়া রাশিয়া এ বার দেশ, মহাদেশের সীমানা পেরিয়ে যুদ্ধটা ছড়িয়ে দিতে চলেছে মহাকাশেও।
আমেরিকার গোয়েন্দা উপগ্রহগুলোর পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে যে সংস্থা সেই ‘ন্যাশনাল রিকনাইস্যান্স অফিস’(এনআরও)-এর অধিকর্তা ক্রিস্টোফার স্কোলেস এমন হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। আক্রমণের প্রথম দিন ইউক্রেনে নিহত হয়েছে ১৩৭ জন। নিহতদের মধ্যে সামরিক ও বেসামরিক মানুষও রয়েছে। আহত হয়েছে আরও ৩১৬ জন।
এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় ইউক্রেনে সামরিক অভিযানে রাশিয়ার অন্তত ৪৫০ সেনা নিহত হয়েছে বলে দাবি করেছেন যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষা সচিব বেন ওয়ালেস। ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিরক্ষাসচিব রেডিও-৪-এ দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এমন দাবি করেন।
সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান বলেন, ‘পাবনার ঈশ্বরদীর রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাস্তবায়িত হচ্ছে। যদি রাশিয়া ও রাশিয়ার বিভিন্ন সংস্থা পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার আওতায় চলে আসে তাহলে আমাদের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাস্তবায়ন অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে। তাই আমাদেরকে কৌশলগত সতর্ক থাকতে হবে প্রতি মুহূর্তে।’
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশিদ আমার সংবাদকে বলেন, ‘বাংলাদেশের সাথে রাশিয়ার বাণিজ্য ও সামরিক সম্পর্ক আছে। রাশিয়ার সাথে বাংলাদেশের বেশ কিছু উন্নয়নমূলক প্রজেক্ট চলমান রয়েছে। রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প অন্যতম। যুদ্ধ নিয়ে রাশিয়া যদি ঝামেলায় পড়ে যায় তাহলে তাদের সাথে বাংলাদেশে চলমান প্রকল্পগুলো চালু রাখা চ্যালেঞ্জ দেখা দেবে। এটা হবে বাংলাদেশের জন্য একটি ধাক্কা। সেটার কারণেই আমাদের শঙ্কার জায়গা।’
তিনি আরও বলেন, ‘রাশিয়া গত বছর আমাদের সামরিক বাহিনীকে অস্ত্র ক্রয় করার জন্য লোন দিয়েছিল। সেই অংশ থেকে বিমানবাহিনী কিছু যুদ্ধ ও কিছু ট্রেনিং বিমান ক্রয় করেছে। এটির কারণে রাশিয়ার সাথে বাংলাদেশের সু-সম্পর্ক নয়, রাশিয়ার সাথে বাংলাদেশের সু-সম্পর্কের কারণে হচ্ছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় রাশিয়া সব থেকে বেশি সমর্থন করেছিল এবং আমাদের বিজয় ত্বরান্বিত হয়েছিল। কাজের সেই ঐতিহাসিক সম্পর্কটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
সেই গুরুত্বের কারণেই রাশিয়া অবশ্যই বাংলাদেশকে পাশে পেতে চাইবে। এটা তারা আশা করতেই পারে। আর বাংলাদেশ তাদের সম্পর্কের ভিত্তি হিসাব-নিকাশ করে করবে। এটা আমাদের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ । তাই সব মিলে সতর্ক সচেতন থাকতে হবে। এই যুদ্ধকে আমাদের গভীর ভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে কোন বিষয়টি বাংলাদেশকে বেশি ঝুঁকিতে ফেলতে পারে।’
মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশিদ আরও বলেন, ‘যুদ্ধ যখন ইউরোপ কন্টিনেন্টে হয়। সেই যুদ্ধের ফল এসে পড়ে অর্থনীতির ওপর। এখানে দুটি বিষয় আমরা দেখছে পাচ্ছি। ইউক্রেনে রাশিয়া তাদের যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে মাঠে নেমেছে। অপর দিকে ন্যাটো আর বাইডেন ইকোনমি অর্থনীতির মাধ্যমে রাশিয়াকে শায়েস্তা করতে চায়। এটি নিয়ে যখন মোকাবিলা হচ্ছে, তখন বিশ্বের অর্থনীতির ধারাটা ব্যাহত হবে। অর্থনীতির প্রবাহ মারাক্তকভাবে ব্যাহত হবে এবং ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষতি হবে।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ পৃথিবীর বাইরে নয়। পৃথিবীর মধ্যের একটা দেশ। তার এর প্রভাব বাংলাদেশেও পড়বে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ আমার সংবাদকে বলেন, ‘রাশিয়া ইউক্রেনের যে যুদ্ধ, এই যুদ্ধ কোথায় গিয়ে শেষ হয় তা সঠিক বলা মুশকিল। তবে তাদের এই যুদ্ধের বিষয়ে বাংলাদেশকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে। পরিস্থিতি কোন দিকে যায় সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের ফলে জান্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম ওঠা-নামা করতে পারে। যদি সত্যিই জ্বালানি তেলের দাম ওঠা-নামা করে তবে তার সমস্যার সৃষ্টি হবে। রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের ভয়াবহতা বৃদ্ধি পেলে পুরো বিশ্বই ক্ষতির মুখে পড়বে। এখন দেখার বিষয় রাশিয়ার ফোর্স যেখানে আছেন, সেখানে থাকবেন না কি অতিক্রম করে আরও এগিয়ে যাবে।’
সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির আমার সংবাদকে বলেন, ‘এই যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে বিশ্ব অর্থনীতি ও বিশ্ব রাজনীতিসহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই নানামুখী প্রভাব প্রতিক্রিয়া পড়বে। তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর দাম বৃদ্ধি পাবে। এই যুদ্ধের কারণে শুধু বহির্বিশ্ব নয়, বাংলাদেশেও প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে অর্থনীতির ওপর আঘাত আসতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির একটা আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষ করে বিশ্ববাজারে তেলের দাম বৃদ্ধি পেলে নিশ্চিত এর প্রভাব বাংলাদেশে পড়বে এবং সাধারণ মানুষ বেকায়দায় পড়ে যাবে। কাজেই এই বিষয়ে সতর্ক থাকার বিকল্প নেই।’
বাংলাদেশের অন্যতম সামরিক ব্যক্তিত্ব, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন আমার সংবাদকে বলেন, ‘পরিস্থিতি দেখে স্পষ্ট মনে হচ্ছে রাশিয়া গভর্নমেন্ট চেঞ্চ করবে। এটা নিয়ে ইউরোপ-আমেরিকা কিছু করতে পারবে না। কারণ আমেরিকা আগে যে গায়ের জোর দেখিয়েছে, এখন রাশিয়া সেই গায়ের জোর দেখাচ্ছে। তবে তাদের কারণে বিশ্বের ছোট ছোট দেশগুলো ওপর এক ধরনের আশঙ্কা সৃষ্টি হচ্ছে।’