Thursday, October 3সময়ের নির্ভীক কন্ঠ
Shadow

নার্সিং খাতে পরিবর্তনের হাওয়া

সীমান্ত ডেস্ক:

  • ২৪ হাজারের বেশি নার্স নিয়োগ দিয়েছে শেখ হাসিনার সরকার
  • প্রস্তাব করা হয়েছে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি ইউনিভার্সিটি স্থাপনের
  • এখন দেশেই রয়েছে নার্সিংয়ে মাস্টার্সের সুযোগ
  • বন্ধ হয়েছে নার্স বদলিবাণিজ্য ও দালালদের দৌরাত্ম্যের অভিযোগ
  • করোনাকালে সাহস-উৎসাহ দিতে মাঠে ঘুরেছেন মহাপরিচালক

সেবা পরিদপ্তর থেকে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তর। দক্ষ জনবল তৈরি আর নার্সিং সেবা প্রদানে প্রতিষ্ঠানটির বেড়েছে পরিধি। বিশ্বমানের নার্স তৈরি করার জন্য এখন ২০টিরও বেশি সরকারি কলেজে এবং ১০২টির বেশি বেসরকারি কলেজে গ্র্যাজুয়েট নার্স ভর্তি নেয়া হচ্ছে। কয়েক হাজার গ্র্যাজুয়েট নার্স ইতোমধ্যে পাস করে বের হয়েছেন।

বিদেশ-নির্ভরতা কেটেছে নার্সিংয়ে মাস্টার্স করার বিষয়ে। রাজধানীর মুগদায় নার্সিং উচ্চশিক্ষা ও গবেষণাকেন্দ্র (নিয়ানার) প্রতিষ্ঠার পর সম্প্রতি তিনটি ব্যাচ দেশেই মাস্টার্স সম্পন্ন করেছে। অথচ ২০১৬ সালের আগেও নার্সিংয়ে মাস্টার্স করার জন্য বিদেশে পাড়ি জমাতে হতো। চিকিৎসাসেবায় নার্সদের ঘাটতি পূরণে বর্তমান সরকার নিয়োগ দিয়েছে প্রায় ২৪ হাজার নার্স। 

এদিকে সরকারি-বেসরকারি নার্সিং ও মিডওয়াইফারি প্রতিষ্ঠানে একই মানের অধ্যক্ষ, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীর পদ সৃজনের রয়েছে উদ্যোগ। রয়েছে দক্ষ শিক্ষক গড়ার লক্ষ্যে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি প্রশিক্ষণ কলেজ নির্মাণের প্রস্তাব। শুধু তা-ই নয়, প্রস্তাব করা হয়েছে স্বতন্ত্র নার্সিং ও মিডওয়াইফারি ইউনিভার্সিটি স্থাপনেরও।

এছাড়া প্রতিটি নার্সিং কলেজে অত্যাধুনিক ভার্চুয়াল সিমুলেশন ল্যাব স্থাপনের কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। দেশের যে ৯ জেলায় এখনো সরকারি নার্সিং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই, সেসব জেলায় কলেজ স্থাপনের উদ্যোগ রয়েছে। বর্তমান সরকারের আমলেই এসব পরিবর্তন ঘটেছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে তার নির্দেশনায় নার্সিং অধিদপ্তর এগিয়ে যাচ্ছে। অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সিদ্দিকা আক্তার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে নার্সিং অধিদপ্তর, নার্সিং শিক্ষা ও নার্সিং সেবা খাতকে আমূল পরিবর্তন করার জন্য পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। 

২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে সিদ্দিকা আক্তার মহাপরিচালক হিসেবে যোগদানের পর ১০ হাজার নার্সের পদ সৃজনসহ ৫ হাজার ৭৫ জন সিনিয়র স্টাফ নার্স নিয়োগ প্রদান এবং শূন্যপদসহ আরও ৮ হাজার ২৮৮ নার্সের পদায়ন প্রক্রিয়া সম্পন্নের উদ্যোগ নেন। দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ৫ হাজার মিডওয়াইফের পদ সৃজনের প্রস্তাবনা পাঠানো হয় এবং এক হাজার ৪০১ জনের নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। অধিদপ্তরের কার্যক্রমে আরও গতি আনতে উদ্যোগ নেয়া হয় প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের।

নার্সরা জানান, সিদ্দিকা আক্তার দায়িত্ব নেয়ার পর গুরুত্ব দেন দেশের নার্সদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে। সে লক্ষ্যে তিনি প্রশিক্ষণ কার্যক্রমকেও বিকেন্দ্রীকরণ করেন। আগে যেসব প্রশিক্ষণ ঢাকায় হতো, সেসব প্রশিক্ষণ বিভাগীয় পর্যায়ে আয়োজনের উদ্যোগ নেন। সরাসরি সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে দ্রুততম সময়ের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত কর্মস্থলে বদলির ব্যবস্থা করেন। নার্স বদলিবাণিজ্য ও দালালদের দৌরাত্ম্যের যে বদনাম ছিল, বর্তমান মহাপরিচালকের সময়ে সেই কলঙ্কমুক্ত হয়েছে অধিদপ্তর। 

অধিদপ্তর সূত্র জানায়, দেশের নার্সিং শিক্ষায় একই মান বজায় রাখতে সব সরকারি নার্সিং ও মিডওয়াইফারি প্রতিষ্ঠানে একই মানের অধ্যক্ষ, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীর পদ সৃজনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। দক্ষ শিক্ষক গড়ে তুলতে জাতীয় পর্যায়ে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি প্রশিক্ষণ কলেজ নির্মাণের প্রস্তাব করেছে অধিদপ্তর। প্রস্তাব করা হয়েছে স্বতন্ত্র নার্সিং ও মিডওয়াইফারি ইউনিভার্সিটি স্থাপনের। দেশের প্রতিটি নার্সিং কলেজে অত্যাধুনিক ভার্চুয়াল সিমুলেশন ল্যাব স্থাপনের কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। 

এছাড়া ১৩টি নার্সিং কলেজের পূর্ণাঙ্গ জনবলের পদ সৃজনের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে আছে। নার্সিং শিক্ষার প্রসারে এ পর্যন্ত চার হাজার ৩০৫টি ও মিডওয়াইফে দুই হাজার ১৩৫টি ভর্তির আসন বৃদ্ধি করা হয়েছে। নার্সিংয়ে উচ্চশিক্ষার সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে নিয়েনারে ৬০টি আসন বৃদ্ধিসহ সরকারি আরও ১০টি নার্সিং কলেজে এমএসসি নার্সিং, ৫টিতে দুবছর মেয়াদি পোস্ট বেসিক নার্সিং ও ৪টিতে পোস্ট বেসিক বিএসসি মিডওয়াইফারি চালুর প্রশাসনিক অনুমোদন দেয়া হয়েছে।  

এছাড়া দেশের ৭টি নার্সিং কলেজের নির্মাণকাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। খাগড়াছড়িতে নির্মাণ করা হয়েছে একটি আধুনিক নার্সিং কলেজ। দেশের যে ৯ জেলায় এখনো সরকারি নার্সিং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই, সেসব জেলায় কলেজ স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে নার্সিং অধিদপ্তর। 

এছাড়া পিপিপির আওতায় ঢাকার মহাখালীতে ইউনিভার্সেল নার্সিং কলেজ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের নির্মাণকাজ চলমান রয়েছে। নার্সিং ও মিডওয়াইফারি শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করতে স্টাইপেন্ড বৃদ্ধিসহ প্রতি বছর কৃতী ৩ শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তি দেয়ার প্রথা চালু করা হয়েছে। গত দুই অর্থবছরে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের জন্য দুজনকে দক্ষিণ কোরিয়া, তিনজনকে থাইল্যান্ড ও একজনকে জাপানে পাঠানো হয়েছে।

অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, ২০২০-২১ অর্থবছরে অপারেশনাল প্ল্যানের অধীনে ১২০০ নার্সকে আইসিইউ, ৬০০ জনকে আইপিসি, ২১০ জনকে পেডিয়াট্রিক, ৯ হাজারকে ফাউন্ডেশন, ১৬০ জনকে ইংরেজি ভাষা, ১২০ জনকে কম্পিউটার, ১২০ জনকে অর্থব্যবস্থাপনা, ১২০ জনকে গেরিয়াট্রিক নার্সিং প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

এছাড়া ৩২ মিডওয়াইফকে সুইডেনের ডালার্না ইউনিভার্সিটির অধীনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রির জন্য নির্বাচিত করা হয়েছে। নার্সিং শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে ইতোমধ্যে ২৫০ জনকে টিচিং মেথোডোলজি প্রশিক্ষণ দিয়ে পদায়ন ও দক্ষ শিক্ষক সমস্যা সমাধানে আরও ৮০০ শিক্ষককে পদায়ন ও প্রশিক্ষণের কাজ চলমান রয়েছে। মাস্টার ট্রেইনার হিসেবে ৫০-৬০ শিক্ষককে বিদেশে প্রশিক্ষণেরও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। নার্সিং ও মিডওয়াইফারি গবেষণা কার্যক্রমকে আরও গতিশীল ও কার্যকর করতে অধিদপ্তরে চালু করা হয়েছে রিসার্চ শাখা। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রথম শ্রেণির শূন্যপদ পূরনের লক্ষ্যে ১৯০ জনের একটি পদোন্নতি তালিকা পাবলিক সার্ভিস কমিশনে অনুমোদনের জন্য প্রেরণ করা হয়েছে।

নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের নতুন ভবনে স্থাপন করা হয়েছে বেবি কর্নারসহ ৩০০ সিটের অত্যাধুনিক ডিজিটালাইজড অডিটোরিয়াম, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং নার্সিংয়ের প্রবক্তা ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের ম্যুরাল ও বঙ্গবন্ধু কর্নার। ডিজিটালাইজেশনের অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে অধিদপ্তরের আওতাধীন সব নার্স, মিডওয়াইফ ও কর্মকর্তা-কর্মচারীর অনলাইন ডাটাবেজ তৈরি করা হয়েছে। শক্তিশালী ও জোরদার করা হয়েছে ই-নথি কার্যক্রমও।

শুধু অধিদপ্তর আর তার কর্মকর্তাদের ভূমিকাতেই এগিয়ে যায়নি এই সেবা খাত। এখানে রয়েছে নার্সদেরও স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। করোনাকালে সবাই পালিয়ে গেলেও রোগীর সঙ্গে থেকেছেন নার্স। সেবা আর মমতায় সুস্থতার দিকে নিয়েছেন জটিল রোগীকে। এজন্যই তো করোনাকালে বাংলাদেশ হয়েছে বিশ্বে অন্যতম দেশ। এজন্য অবশ্য নার্সদের রয়েছে অনেক ত্যাগ। 

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) তথ্যমতে, গত ২২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশে ৯ হাজার ৬১১ জন চিকিৎসক, নার্স  ও স্বাস্থ্যকর্মী কোভিড আক্রান্ত হয়েছেন। তার মধ্যে তিন হাজার ১৮২ জন চিকিৎসক, দুই হাজার ৩৭০ নার্স এবং চার হাজার ১৩৯ জন স্বাস্থ্যকর্মী।

শেয়ার বাটন